আইনি ব্যবস্থার রকমফের
তাসমিরুল ইসলাম (উদয়)
আধুনিক বিশ্বে বর্তমানে যতগুলো আইনি ব্যবস্থা রয়েছে
তা উৎসগত দিক থেকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত_ সিভিল
ল ব্যবস্থা এবং কমন ল ব্যবস্থা। এ ছাড়া আরো কিছু
আইনি ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। যেমন আফ্রিকার বিভিন্ন
দেশে প্রথাগত আইনের প্রচলন; মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন
দেশে ধর্মীয় আইনের প্রচলন। আবার কোনো কোনো
দেশে সিভিল ল ও কমন ল ব্যবস্থার মিশেলে গড়ে উঠেছে
মিশ্র আইনি ব্যবস্থা।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের পেনিসিলভিয়া
রাজ্য কিংবা কানাডার কুইবেক রাজ্য; যেখানে একই সময়ে
একাধিক আইনি ব্যবস্থার চল রয়েছে।
বর্তমান আধুনিক আইন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সব থেকে
প্রাচীন হচ্ছে 'সিভিল ল' ব্যবস্থা। এর উৎপত্তিগত
ভিত্তি বহু দিনের পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ সালে রোমান
প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা সর্বপ্রথম তাদের
সামাজিক প্রথাগুলো আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে। এ আইনগুলোর প্রচলন তখন শুধু রোমের জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তখন তা 'জাস সিভিলি বা 'সিভিল ল' নামে পরিচিত ছিল। রোম প্রজাতন্ত্রের বিচারকার্য পরিচালনায় রোমের অভিজাত
(পেট্রিসিয়ান) শ্রেণির বৈষম্যমূলক ও স্বেচ্ছাচারী আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে রোমের সাধারণ বা নিম্ন (প্লেবিয়ান) শ্রেণির মানুষ তাদের
প্রতি প্রয়োগকৃত আইনগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জনের জন্য ব্যবহৃত আইনগুলোর লিখিত কাঠামো তৈরির জোর দাবি
জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৯-৪৫১ সাল পর্যন্ত ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর 'টুয়েলভ ট্যাবলস'
বা ১২টি মূলনীতিসংবলিত প্রথম লিখিত আইনের একটি কাঠামো তৈরি করে। যদিও এটি ছিল রোমের জনগণের ওপর প্রয়োগকৃত
প্রথাগুলোর লিখিত রূপমাত্র কিন্তু এই 'টুয়েলভ ট্যাবলস' অনুসারে বিচারকার্য পরিচালনা তৎকালীন বিচারকদের জন্য বাধ্যতামূলক
ছিল।
পরে রোমের প্রতাপশালী সম্রাট জাস্টিনিয়ান (৫২৭-৫৬৫) সমগ্র
ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও পূর্বাঞ্চলগুলো রোমের অধীন করে
সেসব অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রথাগত ভিন্নতার বিড়ম্বনা
এড়িয়ে একটি আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য তৎকালীন
আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন এবং প্রচলিত সব
রোমান আইনসংবলিত একটি আইনি কাঠামো তৈরির নির্দেশনা দেন;
যা পরে 'জাস্টিনিয়ান কোড' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আজকের
'সিভিল ল' ব্যবস্থা ভিত্তিগত দিক থেকে পুরোপুরিভাবে 'টুয়েলভ
ট্যাবলস' বা ১২ নীতি এবং 'জাস্টিনিয়ান কোডের' প্রতি ঋণী।
'সিভিল ল' ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আইনপ্রণেতারা যেভাবে
আইনের কাঠামো তৈরি করে দেবেন, ঠিক সেভাবেই বিচার বিভাগ
প্রয়োগ করতে বাধ্য থাকবে। এ ক্ষেত্রে আইনের যাবতীয় ব্যাখ্যা ও
খুঁটিনাটি দিক আইনপ্রণেতারাই তৈরি করবেন। এ ব্যবস্থায় বিচারকরা
কেবল আইন বিভাগ প্রণীত আইনের বিধান অনুসারেই বিচারিক কাজ
করেন। এখানে মামলার রায়ে বিচারকদের নিজস্ব মতামত দানের স্থান
খুবই সীমিত বা নেই বললেই চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারকরা মতামত দিলেও তা বাধ্যকরী আইন হিসেবে নিম্ন আদালত
কর্তৃক অনুসরণীয় নয়।
আধুনিক আইনি ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে 'সিভিল ল' ব্যবস্থাকে সব থেকে স্বচ্ছ ও সুগঠিত আইন ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
কারণ 'সিভিল ল' ব্যবস্থায় আইনসভা কর্তৃক লিখিত আইনে প্রতিটি সমস্যাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের বিশদ বিধান
উল্লেখ থাকে। এমনকি দূরবর্তী সম্ভাব্য কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধানও দেয়ার চেষ্টা থাকে এ
ব্যবস্থায়। এ ব্যবস্থায় প্রয়োজন অনুসারে ব্যাপকহারে নিত্যনতুন আইন প্রণীত হয়। 'সিভিল ল' ব্যবস্থায় প্রতিটি সমস্যা
সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতকরণের কারণে বিচারক খুব সহজেই লিখিত আইন থেকে সমস্যাটির সমাধান বের করে ফেলতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে অভিযুক্তকে শাস্তি প্রদান বা অব্যাহতি দেয়া পর্যন্ত ঘটনাগুলোর মধ্যবর্তী সময়ে
মামলার বাদীকে শুধু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও প্রমাণের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এর ফলে মামলা যথেষ্ট কম
সময়ে নিষ্পত্তি হয়। এ ব্যবস্থায় বিচারক অভিযোগ তদন্ত ও প্রমাণের জন্য অভিযুক্তকে প্রয়োজনমতো জেরা করতে পারে। মজার
ব্যাপার হলো, এ ব্যবস্থায় আদালতের অভ্যন্তরে আইনজীবীদের 'নীরব দর্শক' বলা যেতে পারে। আইনজীবীরা আদালতের বাইরে
মক্কেলকে পরামর্শ দেন আর আদালতের ভেতর বিচারককে মামলাসংশ্লিষ্ট আইনগত তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। 'সিভিল ল' ব্যবস্থার
আরেকটি ভালো দিক হলো, আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের সময় আইন বিশেষজ্ঞদের কার্যকর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীতে
প্রায় ১৫০টি দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
আধুনিক আইনি ব্যবস্থায় 'কমন ল' ব্যবস্থার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। ১০৬৬ সালে নরম্যানদের ইংল্যান্ড বিজয়ের পরই মূলত
'কমন ল' ব্যবস্থার উৎপত্তি। এ ব্যবস্থার উৎপত্তি ও প্রয়োগের সীমা ভৌগোলিকভাবে কখনো খুব বেশি বিস্তৃত ছিল না। ১০৬৬
সালের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলের জনগণ বিক্ষিপ্ত কিছু নিয়মনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ১০৬৬ সালে
নরম্যানদের দ্বারা রাজতন্ত্র যাত্রা করার পর তাদের অধিকৃত সব অঞ্চলের প্রথাগুলো ও রাজা কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন নীতিমালা
একত্র করে একটি সমন্বিত আইনি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয় এবং রাজার আদালতে সেগুলোর প্রয়োগ করা হয়। রাজার আদালতে
মামলাজট কমানোর জন্য নতুন একটি ধারণার সংযোজন করা হয়। তা হলো, আগে সমাধানকৃত কোনো ঘটনা পরে আসা কোনো
ঘটনার সঙ্গে যদি সাদৃশ্যপূর্ণ হয় তবে পরে আসা ঘটনার বিচারে আগের দেয়া সিদ্ধান্ত বাধ্যকরী আইন হিসেবে বিবেচিত হতো।
পরে এ নীতি এতটাই প্রসার লাভ করে যে, বিচারকদের প্রদত্ত বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে নতুন নতুন নীতির উদ্ভব এবং সেগুলো নিম্ন
আদালতগুলোয় বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করা হতে থাকে।
শুধু তাই নয়, 'কমন ল' ব্যবস্থায় আইনপ্রণেতাদের প্রণীত আইনের ব্যাখ্যার দায়িত্বও বিচারকদের ওপর বর্তায়। যদিও 'কমন ল'
ব্যবস্থায় আইনপ্রণেতারাই আইনসভায় মৌলিক আইন প্রণয়ন করেন, তবে তা সিভিল ল ব্যবস্থার মতো অতটা পূর্ণাঙ্গ ও
বিশ্লেষণমূলক থাকে না। 'কমন ল' ব্যবস্থায় আইনের কেবল একটি কাঠামো তৈরি করে দেয়া হয় এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়ে
দেয়া হয় যার আওতার মধ্য থেকে বিচারকরা তাদের বিচারিক ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে নতুন নতুন নীতির সৃষ্টি করেন; যা
নজির হিসেবে নিম্ন বিচারালয়গুলোর জন্য বাধ্যতামূলক হয়। তবে যে ক্ষেত্রে কোনো ঘটনার নজির থাকে না, সে ক্ষেত্রে নিম্ন
বিচারালয়ের বিচারক তার নিজ বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে নতুন নীতির সৃষ্টি করতে পারেন।
'কমন ল' ব্যবস্থায় একজন বিচারক যেমনিভাবে বৃহৎ পরিসরে তার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করতে পারেন, তেমনিভাবে আইনজীবীরাও
তাদের বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের দারুণ সুযোগ পান। এ ব্যবস্থায় বিচার প্রক্রিয়া খুব বেশি কাঠামোবদ্ধ ও আচারসর্বস্ব হওয়ার কারণে
মামলাগুলোর নিষ্পত্তি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে মাত্র ৮০টির মতো দেশে 'কমন ল' ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এগুলো সবই ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। তবে
আইন 'সিভিল' হোক বা 'কমন'_ এ দুই ব্যবস্থাতেই মৌলিক আইন বা আইনের কাঠামো প্রণয়নের দায়িত্ব ওসব দেশের আইনসভার
হাতেই থাকে। কেউ এর প্রয়োগের দড়ি খানিকটা এঁটে রেখেছে কেউ বা খানিকটা আরামদায়ক করে ছাড় দিয়ে রেখেছে এমন নয়, দড়ি
আইনপ্রণেতাদের হাতেই থাকে।